ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কখনো ভেবেছেন ডিপ্লোমা বা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে এসে কীভাবে আপনি আপনার ক্যারিয়ার গড়ে তুলবেন? সফটওয়্যার, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং কিংবা অন্যান্য প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ভালো চাকরি পেতে কীভাবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই—ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং। তবে, অনেক শিক্ষার্থী এই ট্রেনিং নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। ঠিক কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন? পরবর্তী চাকরির সুযোগ কেমন? এক্ষেত্রে সঠিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংই আপনাকে কর্মক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী এবং দক্ষ করে তুলতে সাহায্য করবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের বিস্তারিত:
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট Vs ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং
ডিপ্লোমা বা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রায়ই কম থাকে। বাংলাদেশের মতো প্রতিযোগিতামূলক জব মার্কেটে প্রাকটিক্যাল স্কিল ছাড়া চাকরি পাওয়া কঠিন, তাই চাকরিদাতাদের কাছে প্রাথমিক মূল্যায়নের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং। মূলত, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং বলতে ইন্টার্নশিপকেই বোঝায়। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয় বা কোর্সের সাথে সম্পর্কিত কোনো অফিস বা ইন্ডাস্ট্রিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করে বাস্তব দক্ষতা অর্জন করেন।
৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ও বিএসসি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্টে অংশ নেন। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের প্রাকটিক্যাল দক্ষতাই বাড়ায় না, বরং চাকরির বাজারে তাদের চাহিদা বাড়াতেও সহায়ক হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং কী?
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা যা তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করে। এই ট্রেনিংটি মোট ১৬ সপ্তাহের হবে, যার মধ্যে ১২ সপ্তাহ আপনি একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় কাজ করবেন এবং বাকি ৪ সপ্তাহ ইন্সটিটিউটে প্রাকটিক্যাল ক্লাস করবেন। এই সময়ে, আপনাকে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে যাতে আপনি আপনার কাজের অভিজ্ঞতা ও শেখা বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। এটি পরবর্তীতে পরীক্ষকদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে যেখানে আপনার উপস্থিতি কমপক্ষে ৮০% নিশ্চিত করতে হবে।
এই ট্রেনিং মোট ৩০০ নম্বরে মূল্যায়িত হবে যার মধ্যে ২০০ নম্বর ইন্ডাস্ট্রিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য এবং ১০০ নম্বর ইন্সটিটিউটে। এই ট্রেনিংয়ের শেষে মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার সফলতা মূল্যায়িত হবে। এই ট্রেনিংটি শুধুমাত্র আপনার একাডেমিক এর সার্থকতা প্রমাণ করবে না, বরং আপনাকে ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুত করবে।
কোন বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং করবেন?
ডিপ্লোমা বা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার পর অনেক শিক্ষার্থী এই দোটানায় পড়েন যে, কোন সেক্টরে কাজ করলে ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পেতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট সিধান্ত গ্রহণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার পরামর্শ হলো প্রথমে আপনি নিজের ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করুন। আপনি কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান? তারপর মার্কেটে সেই পেশার চাকরির সম্ভাবনা বা চাকরি পাওয়ার সুযোগ কেমন তা যাচাই করুন।
এছাড়া, একধাপ এগিয়ে যেতে আপনাকে ভবিষ্যতের পেশাগত অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। আগামী ৫-১০ বছর পর আপনার পছন্দের সেক্টরে চাকরির অবস্থা কেমন হতে পারে? এটি জানতে হলে খুব বেশিদূর যেতে হবে না, সহজেই ঘরে বসেই গবেষণা করে জানা যায়। বিভিন্ন জব পোর্টালগুলো নিয়মিত ভিজিট করুন যা আপনাকে চাকরির বাজার সম্পর্কে ধারণা দেবে। যেমন, Study Litesc ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে একটি জব পোর্টাল চালু করেছে। Jobs লিঙ্কে গিয়ে আপনি বিভিন্ন পেশার চাকরি গুলি দেখতে পারেন এবং কোন পেশায় সবচেয়ে বেশি চাকরি রয়েছে, তা শর্টলিস্ট করতে পারেন।
এভাবে, আপনার পছন্দের সাবজেক্ট বেছে নিন এবং সেই বিষয়ের উপর দক্ষতা অর্জনের জন্য একটি লিস্ট তৈরি করুন। এরপর সেই লিস্ট অনুযায়ী ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট বা ট্রেনিং-এর জন্য প্রস্তুতি নিন যাতে আপনি ভবিষ্যতে আপনার পছন্দের পেশায় সফল হতে পারেন।
কোথায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং করবেন?
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং এর জন্য সঠিক প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আপনার ক্যারিয়ার গঠনের অন্যতম স্তম্ভ হতে পারে। প্রথমেই আপনাকে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে—আপনার লক্ষ্য কী? আপনি কি ওয়েব ডেভেলপমেন্টে ক্যারিয়ার গড়তে চান নাকি নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করবেন?
ধরুন, আপনি ওয়েব ডেভেলপমেন্টে ক্যারিয়ার গড়তে চান। তাহলে প্রথমে জানুন যে একজন ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে হলে কোন কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। এরপর নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে, আপনাকে জানতে হবে কী কী স্কিলস থাকলে আপনি সফল হতে পারবেন। এসব বিষয় জেনে নিলেই আপনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো বেছে নেবেন তাদেরকে আপনার দক্ষতা অর্জনের লিস্ট দিতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হলো—আপনি যে বিষয়ে ট্রেনিং নিতে চান সেই প্রতিষ্ঠানে তারা কি আপনার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী এক্সপার্ট বানানোর সক্ষমতা রাখে কিনা? যদি উত্তর হয় “হ্যাঁ”, তাহলে নিশ্চিন্তে সেই প্রতিষ্ঠান বেছে নিতে পারেন। কিন্তু যদি না হয়, তাহলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে খুঁজুন। তবে মনে রাখবেন বাণিজ্যিক ট্রেনিং সেন্টার থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন। কারণ সেখানে প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা ও গুণগত শিক্ষা সবসময় সর্বোত্তম হয় না।
ইন্ডাস্ট্রি / ইনস্টিটিউট বাছাই করার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ
অনেক শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়ালেখা শেষ করার পর প্রায়ই ভুল ইনস্টিটিউট বা কম মানের প্রতিষ্ঠান বেছে নিয়ে সময় কাটানোর দিকে ঝোঁকেন। তবে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং নিলে পরে কর্মক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে। তাই ইন্ডাস্ট্রি বা ইনস্টিটিউট বাছাই করার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি:
- ইনস্টিটিউটটির ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাটাচমেন্ট পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা কতটা রয়েছে তা যাচাই করা উচিত। যেহেতু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং মূলত বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের জন্য, তাই যেসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে এই কাজটি করছে, তারা অবশ্যই শিক্ষার্থীদেরকে ভালো প্রশিক্ষণ প্রদান করতে সক্ষম।
- যেসব ইনস্ট্রাক্টর কোর্সটি পরিচালনা করবেন, তারা কি মার্কেট বা ফিল্ডের সাথে সরাসরি জড়িত? যদি ইনস্ট্রাক্টররা বাস্তব অভিজ্ঞতা না নিয়ে শুধুমাত্র থিওরিটিক্যাল জ্ঞান দিয়ে থাকেন, তবে সেটা আপনার জন্য কার্যকর হবে না। মনে রাখবেন, দক্ষ প্রশিক্ষক ছাড়া ভালো ফলাফল আশা করা যায় না। কারণ মাঝি যদি দক্ষ না হয়, তা হলে বড় নৌকাও ডুবতে সময় নেবে না!
- কোর্সের ফি একটি বড় ফ্যাক্টর। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বেশি লাভের আশায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রলোভনে পড়ে অতিরিক্ত ফি দেয়। তবে, কোর্স ফি শুধুমাত্র কোনো প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়ার একমাত্র মানদণ্ড নয়। আপনার নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান কি বাস্তবিক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিচ্ছে, সে বিষয়েও আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ইনস্টিটিউট বা ইন্ডাস্ট্রির দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন শহর থেকে ঢাকা বা অন্য বড় শহরে গিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে যেমন উচ্চ কোর্স ফি, তেমনি থাকা-খাওয়ার খরচও অনেক বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু, যদি আপনি কাছাকাছি কোন ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেন, তাহলে আপনি অনেক টাকা সেভ করতে পারবেন। তাই, যেখানে আপনি ট্রেনিং নেবেন তা আপনার বাসস্থান থেকে অনেক দূরে না হওয়াই ভালো।
এগুলি দেখে আপনি সঠিক ইনস্টিটিউট বা ইন্ডাস্ট্রি বাছাই করতে পারবেন এবং নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনি কোনো ভুল ইনস্টিটিউটের মধ্যে আটকে পড়েন নি।
শেষ কথা
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নয়, বরং এটি তাদের বাস্তব জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির এক অমূল্য সুযোগ। এই ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আপনি শুধু তাত্ত্বিক শিক্ষাই লাভ করেন না, বরং বাস্তব কাজের পরিবেশে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন যা আপনার ভবিষ্যত ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৬ সপ্তাহের এই ট্রেনিংটি আপনার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য দরজা খুলে দেয়। তাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া আপনার জন্য শুধু সঠিক সিদ্ধান্তই না, পাশাপাশি এটি আপনাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।
লিমা খাতুন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং, তেজগাঁও, ঢাকা, প্রকাশ-০৯ নভেম্বর, ২০২৪,
<https://abhinoboschool.com/ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং/>
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং কতদিনের জন্য করতে হয়?
এই ট্রেনিং সাধারণত ১২ সপ্তাহের জন্য করানো হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং শেষে কি টাকা দেওয়া হয়?
সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গুলোতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং শেষে শিক্ষার্থীদের ১২০০০/- টাকা ভাতা প্রদান করা হয়।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য কী?
শিক্ষার্থীদের বাস্তব শিল্প পরিবেশে কাজের অভিজ্ঞতা প্রদান করা, যাতে তারা তাত্ত্বিক শিক্ষা থেকে বাস্তব জ্ঞানে রূপান্তরিত হতে পারে এবং ভবিষ্যতে তাদের পেশাগত জীবনে সফল হতে পারে।