ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং হলো একটি কারিগরি ডিগ্রী যাতে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ও প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা প্রদান করা হয়। এটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক চার বছর মেয়াদি একটি কোর্স যা সাধারণত বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট গুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই ডিগ্রী লাভের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করে খুব সহজেই কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়।
একাডেমিক গ্রেড
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসএসসি এর স্কুলিং বছর তথা শিক্ষাক্রম গ্রেড ১০, এইচএসসি এর শিক্ষাক্রম গ্রেড ১২, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষাক্রম গ্রেড ১৪ এবং অনার্স বা স্নাতক এর শিক্ষাক্রম গ্রেড ১৬। অর্থাৎ এটির ডিগ্রী এইচএসসি এবং স্নাতক এর মাঝামাঝি অবস্থান করে। অনেকেই এটিকে এইচএসসি এর সমমান বলে থাকেন যা কোন ভাবেই সঠিক নয়। তবে বিভিন্ন চাকুরীতে আবেদনের ক্ষেত্রে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা এইচএসসি বা সমমানের চাহিদা সম্পন্ন চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ পায় কিন্তু এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কোন চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে না।
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি
এখানে ভর্তির জন্য সাধারণত এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং নূন্যতম জিপিএ ২.০০ থাকতে হয়। আবেদন পরবর্তীতে মেধার ভিত্তিতে প্রায় ৪৯ টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন টেকনোলজিতে ভর্তির সুযোগ পায়। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় ২২৯ টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এই শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে।
বর্তমানে এইচএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা চাইলে এখানে ভর্তি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা সরাসরি তৃতীয় পর্বে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।
বিভাগ সমুহ
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ টির বেশি বিষয়ে এই ডিগ্রী অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে যেমন সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, কম্পিউটার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত প্রতিষ্ঠিত বিষয় রয়েছে, তেমনি ফুটওয়ার, সিরামিক্স, গ্লাস, কেমিক্যাল এর মত নতুন বিষয়ও রয়েছে যেগুলোর চাকরির বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ডিগ্রীতে সবচেয়ে বেশি পঠিত বিষয়গুলো হলঃ
- সিভিল টেকনোলজি
- আর্কিটেকচার টেকনোলজি
- ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি
- ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজি
- মেকানিক্যাল টেকনোলজি
- পাওয়ার টেকনোলজি
- কম্পিউটার সাইন্স টেকনোলজি
- সার্ভেয়িং টেকনোলজি
- মেরিন টেকনোলজি
- কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি
- শিপ বিল্ডিং টেকনোলজি
- ইলেক্ট্রোমেডিকেল টেকনোলজি প্রভীতি
এর শিক্ষাক্রম সম্পর্কে
এটি একটি ০৪ (চার) বছর মেয়াদী শিক্ষাক্রম কোর্স যা ০৮টি (আট) সেমিস্টার বা পর্বে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথম থেকে সপ্তম সেমিস্টার পর্যন্ত ইনস্টিটিউটে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং অষ্টম পর্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং প্রদান করা হয় যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হাতে কলমে কাজ করা ও শেখার সুযোগ পায়। প্রতিটি সেমিস্টার ৬ মাস মেয়াদী এবং সেমিস্টারের মাঝে ও শেষে যথাক্রমে মিড টার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও নিয়মিত সাপ্তাহিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সেমিস্টারে তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়াও ব্যবহারিক বিষয়ের উপর নম্বর বরাদ্দ থাকে।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সম্বলিত নিজস্ব ল্যাবরেটরি রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এতে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে। এই কোর্সে প্রকৌশল বিদ্যা ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি, ম্যাথমেটিক্স, সোশ্যাল স্কিল এবং ব্যবসায় উদ্যোগ সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে খুব সহজেই আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন সহ-শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকে। যেমন স্কিল ডেভেলপমেন্ট কম্পিটিশন, ডিবেটিং ক্লাব, রোভার ও স্কাউট কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি এ সকল সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এ উচ্চশিক্ষা
এই কোর্স শেষ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা ডুয়েটে বিভিন্ন বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং অর্জন করা যায়। এছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী নির্মাণাধীন চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যথা ঠাকুরগাঁও, নড়াইল, খাগড়াছড়ি ও নাটোরে শুধুমাত্র ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আসন বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারি অনেক ইউনিভার্সিটিতে চাকরির পাশাপাশি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করার সুযোগ রয়েছে।
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় সেখানে এটি শেষে দ্রুত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা যায় ফলে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। এছাড়াও এই কোর্স শেষে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দক্ষ প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ আছে। ক্ষেত্র বিশেষ বিভিন্ন স্কলারশিপের আওতায় বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ পাওয়া যায়। বর্তমানে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কারখানাগুলোয় দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ হতে পারে দেশের উন্নতির অন্যতম হাতিয়ার।
কেন ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত?
বর্তমানে বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে বেকার সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষা শেষে বাংলাদেশের প্রায় ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকে। এই সমস্যা সমাধানের একটি উপায় হতে পারে কারিগরি শিক্ষা গ্রহন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কোর্সে পড়া কেন একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে তা নিম্নরূপঃ
- দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হওয়াঃ সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে সেশন জট এবং বিভিন্ন দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে সেখানে চার বছরের এই কোর্স যথাসময়ে শেষ হয়ে যায়। এই কোর্সে যথাসময়ে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রদান করা হয় ফলে সময়ের অপচয় হয় না বললেই চলে।
- বেকার সমস্যা সমাধান ও দ্রুত চাকরির সুযোগঃ এই কোর্সে পড়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় কম সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে পারে। এতে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা দ্রুত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করতে পারে এবং পরিবারের হাল ধরার সুযোগ পায়। এছাড়াও এটি শেষে প্রায় সকলেই চাকরির সুযোগ পায় এবং কেউ বেকার থাকে না।
- কর্মক্ষেত্রে উচ্চ চাহিদাঃ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যেহেতু তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তাই শিল্প প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোতে তারা সহজেই চাকরির সুযোগ পায়। প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা উচ্চ বেতনে চাকরি করতে পারে।
- পড়াশোনায় সরকারি সহায়তাঃ বর্তমানে এই কোর্সে শিক্ষার্থীদের বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় প্রতি সেমিস্টারে ৪০০০ টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদান করা হয়। ফলে দরিদ্র শিক্ষার্থীরাও সহজেই এই কোর্সে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে থাকে।
চাকরির ক্ষেত্রসমূহ
বাংলাদেশে এই কোর্স শেষে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ রয়েছে। একজন দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার যেকোনো প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি করতে পারেন।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা হলোঃ
- গণপূর্ত অধিদপ্তর
- সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর
- শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর
- স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
- জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
- বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড
- রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
- সকল সিটি কর্পোরেশন
- বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড
- বাংলাদেশ রেলওয়ে
- বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ
- বাংলাদেশ জাতীয় গ্যাস কোম্পানি
- পানি উন্নয়ন বোর্ড
- স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় ইত্যাদি।
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা হলোঃ
- বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থায়
- ইলেকট্রিক্যাল ও পাওয়ার কোম্পানিতে
- বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ও ইন্ডাস্ট্রিতে
- বিভিন্ন সফটওয়্যার আইটি কোম্পানি
- অটোমোবাইল কোম্পানি
- কনসাল্টেন্সি ফার্মে
- শিল্প কারখানায়
- এনজিও ও উন্নয়ন সংস্থায় ইত্যাদি।
পরিশেষে
এটি একটি বাস্তবমুখী শিক্ষা এবং কর্মময় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেয়। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় এর উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করছে। আগামী দিনগুলোতে দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ।
লিমা খাতুন, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, তেজগাঁও, ঢাকা, প্রকাশ-০৫ নভেম্বর, ২০২৪,
<https://abhinoboschool.com/ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং/>
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত প্রশ্ন ও উত্তর
এই কোর্স শেষ করতে কত বছর সময় লাগে?
এই কোর্সটি শেষ করতে চার বছর সময় লাগে।
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে কি সরকারি চাকরি পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় প্রতিবছর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কি এইচএসসি এর সমমান?
না, একাডেমিক গ্রেডে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এইচএসসি এর থেকে উচ্চতর ডিগ্রী।